প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,
সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
[সোর্স](মেটা এ আই)


আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।
বাঙালি নারীদের শাড়ি পছন্দ নয় এমনটা বোধহয় দেখতে পাওয়া যায় না৷ আমরা যতই নানান ধরণের পোশাক পরি না কেন শাড়ির প্রতি লোভ আমাদের জন্মগত। প্রত্যেকের আলমারিতে ভর্তি শাড়ি তবুও শাড়ি একেবারেই নেই। কোথাও যাবার আগেই গালে হাত দিয়ে বসে পড়তে হয়, কি পরব! শাড়ি তো একটিও নেই পরার মতো। ভুল বললাম কি?
এই শাড়ির মধ্যে আমাদের বাঙালিদের (দুই বাংলার) সব থেকে জনপ্রিয় শাড়ি হল ঢাকাই জামদানি। সেই শাড়ি সম্পর্কেই আজকের প্রতিবেদন। চলুন কথা না বাড়িয়ে শুরু করি।
ঢাকাই জামদানি শাড়ি, যা একসময় রাজকীয় পোশাক হিসেবে পরিচিত ছিল, আজও বাংলার নারী সমাজের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসেবে বিবেচিত। বাংলার দুই অংশ—বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ—এই জামদানিকে ভালোবাসে, চিরকাল তার অনন্য সৌন্দর্য ও নকশার প্রশংসা করে। ঢাকাই জামদানির ইতিহাস এক অমোঘ সুতায় বাঁধা, যা হাজার বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কল্পনা শক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জামদানির উৎপত্তি ও নামের উৎস
‘জামদানি’ শব্দটির উৎপত্তি ফারসি ভাষা থেকে—‘জাম’ অর্থ ফুল এবং ‘দানি’ অর্থ বোনা। অর্থাৎ, জামদানি হলো ‘ফুল বোনা কাপড়’। জামদানির উৎপত্তি সম্ভবত প্রাচীন বাংলায় হলেও, এটি মুঘল আমলে ঢাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে গৌতম বুদ্ধের সময় জামদানি বয়নশিল্পের অস্তিত্ব ছিল, তবে তা ছিল একেবারে প্রাথমিক রূপে। মুঘল আমলে ঢাকাই জামদানির আধুনিক রূপের বিকাশ ঘটে এবং জামদানির কাপড় রাজকীয় শাড়ি হিসেবে বিবেচিত হতো।
মুঘল আমলে ঢাকাই জামদানির বিকাশ
মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে ঢাকাই জামদানি শাড়ির জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। সোনারগাঁওয়ের কারিগরেরা জামদানি শাড়ি তৈরি করতেন এবং মুঘল রাজপরিবারের নারীসাধনীদের জন্য এটি তৈরি হতো। মুঘল আমলে শাড়ির নকশা ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং জটিল। একেকটি শাড়ি তৈরিতে বহু দিন লেগে যেত এবং শাড়ির নকশাগুলি ছিল ফুল, পাখি এবং বিভিন্ন মসৃণ প্যাটার্নের সমন্বয়। এই সময়ে ঢাকার জামদানি ছিল শৌখিনতার এক নিদর্শন এবং রাজপুরুষদের মধ্যে এটি ছিল এক প্রকার গৌরবের প্রতীক।
ঔপনিবেশিক যুগে জামদানি শিল্পের পতন
১৮ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসনের কারণে ভারতীয় হস্তশিল্প, বিশেষ করে জামদানি শিল্প, অত্যন্ত ক্ষতির মুখে পড়ে। ব্রিটিশরা যন্ত্রনির্ভর কাপড় শিল্পকে প্রাধান্য দিয়েছিল, ফলে ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের শিল্পীরা আর্থিকভাবে অসুবিধায় পড়েন। জামদানি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম সুতোর সরবরাহ কমে যায় এবং তৈরি হওয়া জামদানির দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ের জন্য অযোগ্য হয়ে যায়। এই সময়েই বহু জামদানি শিল্পী তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জামদানি শিল্পের পুনর্জাগরণ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর, জামদানি শিল্প পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর ১৯৭০-এর দশকে কিছু বেসরকারি সংস্থা এবং সরকারী উদ্যোগে জামদানি শিল্পের পুনরুজ্জীবিতকরণের কাজ শুরু হয়। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘জাতীয় জামদানি কারখানা’ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। এই সময়কার শিল্পীরা প্রাচীন জামদানি শাড়ির নকশা ও শৈলীর সঙ্গে আধুনিকতা যোগ করতে শুরু করেন। জামদানি শাড়ির ওপর আলোকপাত এবং এর জনপ্রিয়তার নতুন ঢেউ আনে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের পরবর্তী সময়ে।
ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি
২০১৩ সালে ইউনেস্কো ঢাকাই জামদানি শাড়িকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি’ হিসেবে ঘোষণা করে, যা জামদানি শিল্পের বৈশ্বিক স্বীকৃতি এনে দেয়। এই স্বীকৃতি পৃথিবীজুড়ে জামদানি শাড়ির গুরুত্ব এবং তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গেও জামদানি শাড়ির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং এটি একটি পণ্য হিসেবে বাজারে জনপ্রিয় হতে থাকে।
জামদানির বৈশিষ্ট্য ও নকশা
ঢাকাই জামদানি শাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর সূক্ষ্মতা ও নকশা। জামদানির নকশায় ফুল, পাখি, লতা-পাতা, সাপের শরীর, প্যারালাল লাইন ইত্যাদি নানা ধরনের ডিজাইন ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি শাড়ি অত্যন্ত সূক্ষ্ম হাতে বোনা হয়, এবং এর মধ্যে রংয়ের ব্যবহার এবং প্রতিটি নকশার অপূর্ব মিলন তাকে একেবারে অনন্য করে তোলে। জামদানি তৈরির জন্য সাধারণত সুতি সূতা ব্যবহার করা হয়, যার ফলে এটি পরতে অত্যন্ত আরামদায়ক এবং শ্বাসপ্রশ্বাসে সহায়ক।
ঢাকাই জামদানির বর্তমান অবস্থান
আজও বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের নারীদের মধ্যে ঢাকাই জামদানি শাড়ির জনপ্রিয়তা কমেনি। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে, বিশেষত ঢাকার সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ, ও নরসিংদী এলাকায় এখনও জামদানি তৈরি করা হয়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গেও কলকাতার কিছু এলাকায় জামদানি তৈরি হয়, যা ঢাকাই জামদানি হিসেবে পরিচিত। আধুনিক জামদানি শাড়ির মধ্যে নতুন নতুন ডিজাইন ও রঙের সমন্বয় হয়েছে, যা পুরনো ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণ ঘটায়।
দুই বাংলার প্রেক্ষাপটে জামদানি
ঢাকাই জামদানির ইতিহাস দুই বাংলায় গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও জামদানি শাড়ির কদর প্রচুর। কলকাতায়, পুরনো বাজারে এবং বুটিকগুলিতে জামদানি শাড়ির বিক্রি এখনও বেশ প্রচলিত। বাংলাদেশের জামদানি শিল্প বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত, এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেক শিল্পীও জামদানির নকশার আধুনিক সংস্করণ তৈরি করছেন।
এছাড়া, ঢাকাই জামদানির ইতিহাস এবং গুরুত্ব দুই বাংলার সংস্কৃতির একটি অমূল্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু একটি ঐতিহ্য নয়, বরং এক ধরনের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে, যা দুই দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য, সম্পর্ক এবং সংস্কৃতির আদান-প্রদানকে উৎসাহিত করছে।
ঢাকাই জামদানি শাড়ি বাংলার ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক গর্বের প্রতীক। এর নকশা, শৈল্পিকতা, এবং সূক্ষ্মতার কারণে এটি শুধু একটি পোশাক নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়। দুই বাংলার মানুষ জামদানিকে নিজের সংস্কৃতির অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচনা করে। মুঘল যুগের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থেকে শুরু করে আধুনিক জামদানি শিল্পের পুনর্জাগরণ—ঢাকাই জামদানির ইতিহাস বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এটি একটি সময়কাল, একটি শিল্প, এবং একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা আগামী প্রজন্মের জন্য অমর হয়ে থাকবে।

পোস্টের ধরণ | জেনারেল রাইটিং |
---|---|
কলমওয়ালা | নীলম সামন্ত |
মাধ্যম | স্যামসাং এফ৫৪ |
লোকেশন | পুণে,মহারাষ্ট্র |
ব্যবহৃত অ্যাপ | ক্যানভা, অনুলিপি |
১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিত গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
https://x.com/neelamsama92551/status/1915352307921019265?t=yPf_WrvcJuvEc8prnOH5mQ&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1915354081390207425?t=JKqI4TB_38sRtFUE2Xrs2Q&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1915354526028341484?t=NBnEZqYiuiHZr_uoZSdl7w&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1915405058012807552?t=n3t37cFKeYBuMoj6eo8Llg&s=19
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
https://x.com/neelamsama92551/status/1915428454691950830?t=_9Gq6UAXXmehMnMCDrwPFQ&s=19
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit