আজ -২৫য় আষাঢ় | ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | বর্ষাকাল |
আসসালামু-আলাইকুম। আদাব - নমস্কার। মাতৃভাষা বাংলা ব্লগিং এর একমাত্র কমিউনিটি আমার বাংলা ব্লগ এর ভারতীয় এবং বাংলাদেশী সদস্যগণ, আশা করি সবাই ভাল আছেন।
সকালটা শুরু হয়েছিল একেবারে সাধারণভাবে। ঘুম থেকে উঠেই দেখি ঘড়িতে সময় প্রায় আটটা। অফিসে পৌঁছাতে হলে নয়টার মধ্যে বাসা থেকে বের হতে হবে। হাতে একেবারেই সময় নেই। তাড়াহুড়ো করে ব্রাশ করলাম, গামছা টাঙাতে টাঙাতে জামা গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
মন-মেজাজ একটু খারাপ ছিল, কারণ আজ মিটিং আছে অফিসে, অথচ রাতে ঘুম ঠিকঠাক হয়নি। রাস্তায় নেমে রিকশা পেলাম না সহজে, অনেকটা হাঁটার পর একটা রিকশা পেলাম। ভাড়া ঠিক করে উঠে বসলাম।
রিকশা ধীরে ধীরে চলছে, আমি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে মেইল চেক করতে শুরু করলাম। এক হাতে রিকশার হাতল ধরে আরেক হাতে ফোন স্ক্রল করছি, তখন হঠাৎ চোখ গেল রাস্তার ডান দিকে, ফুটপাতের পাশে বসে থাকা একজন লোকের দিকে।
লোকটা একটু বয়স্ক, মুখটা কেমন ক্লান্ত আর ধুলো-মাখা। গায়ে ছেঁড়া ময়লা শার্ট, নিচে একটা পায়জামা। পাশে একটা পুরনো ব্যাগ রাখা, তাতে দু-একটা জিনিসপত্র। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো ভিক্ষা চাইবেন। কিন্তু চোখাচোখি হওয়ার পরেও তিনি কিছু বলেননি। শুধু পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
আমি একটু খেয়াল করে দেখলাম, তার পায়ের একপাশে রক্ত জমে আছে। গোড়ালি ফেটে গেছে মনে হলো, আর হাঁটার মতো অবস্থাও নেই। তার মুখে কোনো অভিযোগ নেই, শুধু একরকম চুপচাপ বসে আছেন— যেন কিছু চাওয়ারও শক্তি নেই।
রিকশা তখনও সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ছিল। মন বলল, উঠে গিয়ে কিছু একটা করি। আবার মনে হচ্ছিল, অফিসে দেরি হয়ে যাবে, মিটিং আছে। কিন্তু জানেন, কিছু মুহূর্তে মন আর যুক্তি একসাথে চলে না।
আমি রিকশা থেকে নেমে তার পাশে গিয়ে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম কিছু লাগবে কি না, তিনি তেমন কিছু বললেন না। শুধু একবার মুখ তুলে তাকালেন। সেই চোখের ভেতরে কী যেন একটা ছিল— কষ্ট, ক্লান্তি, কিছু না বলতে পারার অপার ব্যথা।
পাশেই একটা ঔষধের দোকান ছিল। গেলাম, কিছু ব্যান্ডেজ, তুলা, আর একটা অ্যান্টিসেপটিক ওষুধ কিনে আনলাম। সঙ্গে এক বোতল পানি। ফিরে এসে যতটুকু পারি তার পা একটু পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। খুব সুন্দরভাবে কিছু করতে পারিনি, কিন্তু মন থেকে করেছিলাম।
কাজ শেষ হলে লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। কিছু বললেন না। আমি শুধু বললাম, এখানে বেশি সময় বসে থাকবেন না, একটু বিশ্রাম নেন।
রিকশায় ফিরে এসে বসলাম। আমার অফিস আরও দূরে, ট্রাফিক বাড়ছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছিল, অফিসের দেরির চিন্তা আর করছি না। মনে হচ্ছিল, দিনের শুরুটা কোনোভাবে একটু সুন্দর হলো।
প্রতিদিন আমরা রাস্তায় হাঁটি, চলি, কাজ করি। কিন্তু এর মাঝেই এমন অনেক মানুষ থাকে, যারা কিছু চায় না— শুধু চায় কেউ একটু বুঝুক। অনেক সময় তারা নিজের কষ্ট কাউকে বলতেও পারে না। আমরা সবাই ব্যস্ত থাকি, কেউ কারো দিকে তাকিয়ে দেখি না।
সেদিন আমি বুঝেছিলাম, সাহায্য করা মানে শুধু টাকা দেওয়া না। একটা সময়, একটু মনোযোগ, একটু সহানুভূতি অনেক বড় সাহায্য হতে পারে।
লোকটার হয়তো খাবার দরকার ছিল, বা চিকিৎসা, কিন্তু আমি যতটুকু পেরেছি করেছি। আমি জানি, আমার ওই পাঁচ মিনিট হয়তো তার পুরো জীবন বদলে দেয়নি। কিন্তু হয়তো তার সেই দিনের একটা কঠিন সময় সামলাতে কিছুটা সাহায্য করেছে।
আর সবচেয়ে বড় কথা, সেদিন আমি নিজেও ভেতর থেকে হালকা হয়ে গিয়েছিলাম। যত খারাপ মুড নিয়ে বের হয়েছিলাম, সেই সমস্ত রাগ, বিরক্তি যেন একেবারে মুছে গেল। মনে হচ্ছিল, আমি কারো কোনো উপকার করেছি, সেটাই আজকের দিনের সবচেয়ে মূল্যবান কাজ।
জীবনে ছোট ছোট কাজই অনেক সময় বড় হয়ে ওঠে। আমরা ভাবি, বড় সাহায্য করতে না পারলে যেন কিছু করাই হলো না। অথচ সত্যি হলো, চলতি পথে যদি একটুখানি পাশে দাঁড়ানো যায়, তবেই মানুষ মানুষকে অনুভব করতে পারে।
সে দিনটা আমাকে শেখাল— এই শহরে, এই ব্যস্ততার মধ্যে, মানুষ এখনো মানুষ হতে পারে যদি একটু মন দিয়ে দেখে, একটু থামে, আর একটু বুঝতে চায়।
This post has been upvoted by @italygame witness curation trail
If you like our work and want to support us, please consider to approve our witness
Come and visit Italy Community
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit